একটি মিথ্যাকে বারবার বলা হলে তা একসময় সত্যের মতো প্রতীয়মান হয়—এমন কৌশলই আজ ব্যবহার করছে ভারতীয় মিডিয়া। বিশেষ করে বাংলাদেশ সংক্রান্ত বিষয়ে তারা ক্রমাগতভাবে ভাঁড়ামো, গুজব ও বিকৃত তথ্য ছড়িয়ে আসছে। এই অপপ্রচার কেবল প্রতিবেশী একটি রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে না, বরং বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
ভারতীয় মিডিয়ার একটি বড় অংশ এখন কার্যত দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক মতাদর্শ, বিশেষ করে বিজেপির হিন্দুত্ববাদী নীতির প্রচারণার হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানোর ক্ষেত্রেও এই মিডিয়াগুলোর সক্রিয়তা উল্লেখযোগ্য। কখনো তারা বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলকে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর এজেন্ট হিসেবে চিত্রিত করে, কখনোবা চীনপন্থী নীতির উত্থান বলে মিথ্যা তথ্য ছড়ায়।
ধর্মীয় ইস্যুতেও ভারতীয় মিডিয়া গভীরভাবে উসকানিমূলক প্রচারণা চালায়। সংখ্যালঘুদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া কোনো ব্যক্তিগত বা সামাজিক ঘটনার অতিরঞ্জিত বর্ণনা দিয়ে তারা দাবি করে যে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা চরম নির্যাতনের শিকার। শুধু তা-ই নয়, ‘র’ (RAW)-এর সহায়তায় নাটকীয় ভিডিও নির্মাণ করে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশকে হেয় প্রতিপন্ন করার অপচেষ্টাও চলে।
সীমান্ত এলাকায় বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হলে সেটিকে এড়িয়ে গিয়ে তারা বাংলাদেশিদের অনুপ্রবেশকারী, সন্ত্রাসী কিংবা চোরাকারবারি হিসেবে উপস্থাপন করে। অনেক সময় পুরোনো ভিডিও কিংবা অন্য দেশের ভিডিওকে বাংলাদেশের বলে চালিয়ে দিয়ে গুজব তৈরি করা হয়। এসব ভিডিওতে কৃত্রিম ভাষণ ও চিত্র সংযোজন করে তা ভাইরাল করে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়।
এই ধরনের গুজব শুধু তথ্যগতভাবে বিভ্রান্তিকর নয়, বরং বাংলাদেশের জন্য বহুমাত্রিক হুমকি সৃষ্টি করছে। প্রথমত, এই গুজব বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্কে ফাটল ধরায়। দ্বিতীয়ত, এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিভ্রান্তি, উত্তেজনা ও দলীয় বিভাজন বাড়ায়। তৃতীয়ত, ধর্মীয় বিভাজনের মাধ্যমে সামাজিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হয়, যা ভারতের ষড়যন্ত্রেরই অংশ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এসব কারণে বাংলাদেশ সরকার ও সমাজকে এখনই সজাগ হতে হবে এবং পরিকল্পিতভাবে গুজব প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে একটি সরকারি “মিডিয়া রেসপন্স ইউনিট” গঠন করা, যারা ভারতীয় মিডিয়ায় প্রকাশিত ভুয়া খবর তাৎক্ষণিকভাবে যাচাই করে প্রতিকারমূলক তথ্য উপস্থাপন করবে। এছাড়া, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে একটি দক্ষ “ফ্যাক্ট-চেকিং সেল” গঠন করা দরকার, যা প্রতিদিন ভারতীয় গণমাধ্যম পর্যবেক্ষণ করবে।
শিক্ষা ব্যবস্থায় “মিডিয়া লিটারেসি” অন্তর্ভুক্ত করা এখন সময়ের দাবি। মানুষকে শেখাতে হবে কীভাবে গুজব শনাক্ত করতে হয়, কীভাবে সঠিক উৎস থেকে তথ্য যাচাই করতে হয়। সেই সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়াতে গুজব প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
কূটনৈতিকভাবে ভারতীয় হাইকমিশনের মাধ্যমে নিয়মিত প্রতিবাদ জানানো যেতে পারে। সেই সঙ্গে জাতিসংঘ, ইউনেস্কো, সার্কসহ আন্তর্জাতিক ফোরামে এই অপপ্রচারের বিষয়টি তুলে ধরা জরুরি।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—বাংলাদেশের নিজস্ব মিডিয়া শক্তিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় দেশপ্রেমিক, তথ্যনির্ভর কনটেন্ট তৈরি করে বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী করতে হবে।
সবশেষে, আইনি ব্যবস্থাও গ্রহণযোগ্য বিকল্প হতে পারে। বিশেষ করে যেসব ভারতীয় মিডিয়া বারবার গুজব ছড়াচ্ছে, তাদের তালিকা তৈরি করে নিষেধাজ্ঞা জারি করা উচিত। প্রয়োজনে ভুয়া ভিডিও ছড়ানো ইউটিউব চ্যানেল বা সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট রিপোর্ট করে বন্ধ করার প্রক্রিয়াও সক্রিয় করা যেতে পারে।
গুজবকে অবজ্ঞা করলে তা শুধু বাড়ে—সেটা আজকের বাস্তবতা। তাই এখন সময় এসেছে পরিকল্পিত প্রতিরোধের। তথ্যযুদ্ধে জয়লাভ করতে হলে কেবল প্রতিক্রিয়া নয়, প্রভাব সৃষ্টি করাই হতে হবে বাংলাদেশের কৌশল।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।
মতামত লেখকের নিজস্ব; “মাতৃভূমির খবর” সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে সর্বাংশে মিল নাও থাকতে পারে।